আজ সকালে যখন ঘুম ভাঙল, ঘড়িতে দেখলাম ৪:৩০ বেজে গেছে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। বেশ জোরেই। এমন দিনে মন খারাপ আসন্ন। কোনও কাজ আজ আর হবেনা জেনে উঠে পড়লাম, তড়িঘড়ি বিছানার মায়া ত্যাগ করে। হিসেব মতো আজ একুশ দিন হয়ে গেছে আমি একটা অভ্যেস ছেড়েছি। কিন্তু অভ্যেস আমায় ছেড়েছে বলে মনে হলোনা। অগত্যা....খাতা নিয়ে বসা। যা আমার লেখার কথা ছিল সেসব পেনের নিব থেকে পিছলে কোথায় হারিয়ে যায়, আর যাদের কথা কেউ লিখলনা, যাদের কথা কেউ শোনেনি তাদের আমার আজ বড় কাছের বলে মনে হয়। যেন গতজন্মের খুব চেনা কেউ।
চশমা না থাকলে সিঁড়ির ধাপ বুঝতে বেশ অসুবিধা হয়। এক ধাপ থেকে অন্য ধাপের মাঝ বরাবর যে সরলরেখা বিস্তৃত তা খুব অস্পষ্ট লাগে। সন্ধিক্ষণ। আমার ছোটবেলা পেরিয়ে একদিন বড় হয়ে ওঠার মত। ঝাপসা।
এসব অবান্তর কথা ভাবতে ভাবতে ছাদ চলে এল। আজ বহুদিন পর ছাদে এসেছি। ওমা, এসেই দেখি কিট্টু আসছে তরতর করে, ছাদে ঝুঁকে পড়া আম গাছটার ডাল বেয়ে। সেবার ছাদে এসে নতুন বন্ধু জুটেছিল আমার, কিট্টু। এই ইকটুখানি পুঁচকে কাঠবিড়ালি। কেক দিয়ে, কত ডাকাডাকি করে, অনেক সাধ্য সাধনার পর গুটি গুটি পায়ে পাশে এসে বসেছিল। তারপর কেক খেয়ে চলে গেল তিড়িং বিড়িং করে। লক্ষ্মী ছেলে। আচ্ছা, আজ ডাকলে আমায় চিনতে পারবে? ওর মনে আছে আমায়? ডাকতেই একবার থমকে দাঁড়াল, তারপর দে ছুট। বুঝলাম, মনে নেই। ছোটবেলার গল্পগুলো যেমন করে বড় হয়ে উঠেছিল, অতল থেকে উঠে আসা চেনা স্বর তেমন করে স্থায়ীত্ব পায়নি। কীভাবে স্থবির হয়ে ওঠে গতিময়, আজও আমার জানা হয়নি। যাই হোক কিট্টু আসেনি, আজ আমার কাছে কিছু নেই, ওকে খেতে দেওয়ার মতো।
সিঁড়ির ঠিক ওপাশে একটা পাইন গাছ আছে। তারই একটা ডাল ছাদ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেত। শেষবার যখন এলাম দেখেছিলাম একটা কাক শুকনো ডাল ভেঙে ভেঙে বাসা তৈরি করছে। তার পাশে বসে আছে আরেকটা কাক। বুঝলাম, বাবা, মা। সেদিন হঠাৎ খুব ঝড় উঠল। এলোপাথাড়ি হওয়ায় ওদের অর্ধেক তৈরি হওয়া বাসা এক নিমেষে ভেঙে পড়েছিল মাটিতে। এইতো ঠিক এভাবে ভেঙে পড়তে দেখেছি আমি, কতকিছু। সেই পুরোনো যন্ত্রণা, অসহ্য ভয় বিবশ করে দিয়েছিল আমায়। এক জন্ম থেকে অন্য জন্মের মাঝে, এক আঘাত থেকে দ্বিতীয় আঘাতের মাঝে যেন পাহাড় ধ্বসে পড়েছিল সেদিন। "Like those fish dying on the asphalt that damaged the cloud."
যার অভিঘাত আমি জানি। জমাট জমাট অন্ধকারের ঘিরে ধরে আমার অবয়ব হয়ে ওঠা যেখানে আমার মৃতদেহের ওপর দিয়ে ছায়া হেঁটে যায়।
পরদিন পাশের ফাঁকা জমিটা থেকে কিছু ডাল পালা কুড়িয়ে এনে আমার আঁকার সরঞ্জাম রাখা বাক্সটায় করে ওদের কাছে এগিয়ে দিয়ে চলে এসেছিলাম। বিকেলে গিয়ে দেখি বাক্সটা থেকে শুকনো ডালগুলো মুখে করে ওরা বাসা বাঁধছে, আজ দুজনেই হাত, না না ঠোঁট লাগিয়েছে কাজে। একই জায়গায় বাসা বানানো চলছে, একই উদ্যমে। তারপর একটা ছোট্ট ছানা জন্মালো, বড় হল, একদিন দেখলাম ও উড়ে এসে ছাদে বসছে। আচ্ছা, আমি ওর কে হই? জানিনা, কিন্তু কেউ হই। অবশ্যই কেউ হই। আমি ওর ঘাসফুল হই। যার নাম কেউ জানলনা। ভাগ্যিস। নাহলে হয়তো শিমূল তুলো হয়ে ভেসে যেত সেই নাম। হয়তো শিউলি হয়ে ঝরেও যেতে পারত। তার চেয়ে এই ভালো।
আজ সেই পাইন গাছটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে ভাবতে দেখি কখন আলো ফুটে গেছে। বৃষ্টির ঝাপটায় খানিক ভিজেও গেছি। এখন মাকে বলতে হয় না মাথা মোছার কথা, বলতে হয়না শুকনো জামাকাপড় তুলে আনার কথা, বলতে হয়না বৃষ্টিতে ভিজতে নেই। ঠান্ডা লাগবে। আজ বৃষ্টিতে ভিজে মন খারাপ হয়ে আসছে। খুব। ক্রীমসন আর টেরাকোটা মিশে রোদ উঠছে, আর গরম নিঃশ্বাস পড়ছে না। হয়তো জ্বর সেরে গেল। জানলা দিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে আলোর স্রোত আছড়ে পড়ছে। রুমমেটের খাট পেরিয়ে সে আলো আমার কাছে আসেনি। কিন্তু আমি তো আর সেরে উঠতে চাইনা। আমি চাইনা আমার মুখের তিক্ততা গলা দিয়েও নামুক। আজন্ম বেয়াড়া আমি-র সময়জ্ঞান খুব কম। কোথায় কতখানি খরচ অপব্যয় নাম ধারণ করেনা তা জানেনি "হৃদয় অবাধ্য মেয়ে"। আজ ওই আলোটুকু মেখে নীলকন্ঠ পাখি যেন জানলায় এসে বসে। যেন দুরূহ বিস্মৃতি ফিরে যায় বিগত বছরগুলোয়। দুই জন্মের মাঝের চৌকাঠ পেরিয়ে যায় ভিজে একাকার ইউক্যালিপটাস বন। ঝাপসা হতে হতে একসময় মিলিয়ে যায় আলগা সুতোয় বাঁধা পড়া কিছু মুহূর্ত, যে পুরোনো গিটারে সুর বাঁধা হয়নি বহুকাল, তার স্ট্রিং ছিঁড়ে যাওয়ার শব্দ হয়তো পৌঁছে গেল অন্য জন্মের কাছে। জানা যায়নি কত কিছু। জানা যাবেও না কখনো। এই দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে অন্য নাম নিয়ে, অন্য সুরে বাঁধা পড়ছে অযত্নে হারিয়ে যাওয়া মানুষের গান। ঘাসফুলও যে বড় অযত্নে বেড়ে উঠেছিল। তারপর নিজের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অস্তিত্বের টুকরো জড়ো করে সে ফিরে গিয়েছিল। ঘাসফুলের কিছু বীজ অবশ্য ছড়িয়ে পড়ছিল সেদিন। অন্য বসন্তে ওরা ফুটবে। সেদিন যেন ওরা নাম খুঁজে পায়। খুব ইচ্ছে করে ওদের শরণ্য বলে ডাকি। সারা পৃথিবী শুনতে পাবে সেই নাম। প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়বে শরণ্য থেকে নিষাদ হয়ে শরণ্যের কাছে।
ক্রিয়েশান, অ্যানাইলেশান অপারেটর সাজিয়ে অ্যাঙ্গুলার মোমেন্টাম লিখে SU(2) অ্যালজেব্রা মেনে চলে কিনা সেই অঙ্কের হিসেবে পাতার পাতা ভরে যায়, অথচ সঞ্চয়ের হিসেবের পাতায় কত অপচয় বাড়ল, অবাধ্য হৃদয়ে কত শিকল পড়ল, কত ঋণ শোধ হলোনা সে খেয়াল থাকেনা। আচ্ছা, চোখ থেকে জল বের হলে, শান্তি কার? জলের? চোখের? নাকি আমার? রুমমেট, অস্মিতাকে এসব জিজ্ঞাসা করতেই ও বকা দেয়, "গুগল ড্রাইভটা খুলে দেখ Quantum এর খাতা দিয়েছে তোদের।" তারপর প্রাপ্ত নাম্বার আমার মানসিক স্থিতাবস্থার সম্পর্কে অপেক্ষাকৃত ভালো ধারণা তৈরি করলে ও বলেছিল, 'এত ভাবতে নেই'। সত্যিই এত ভাবতে নেই। ভেবে ভেবে নির্ভার হয়ে ওঠা যায়না, ক্ষণিক মোহ, ফ্যান্টাসি কিচ্ছু এড়িয়ে যাওয়া যায়না। তাও এই ভাবনা অসহায়। জানলায় মাথা ঠুকে মরে। রাস্তা জুড়ে বেগুনি রং পড়ে থাকে, দুখজাগানিয়া বিকেলের গোলাপি আলো কখন রাস্তায় মিশে যায়। তাতে বিপ্রতীপ দুই মানুষের অবস্থান বদলায় না। অশ্রুসিক্ত জলছবির মতো দিন আত্মগোপন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ততক্ষণে। অসহ্য শব্দে অবসন্ন হয়ে আসে সমস্ত শরীর। এত নিখুঁত সুর, এত মানুষের চিৎকার, উল্লাস, বিষাদগ্রস্ত ভূতের মতো আঁকড়ে ধরে আমায়। প্রাণপণে আমি পালিয়েছি গাছের শিকড় ধরে ধরে। এই এড়িয়ে যাওয়ার পথ চিনলি অথচ তার দায় নিবি না? মা জানতে চাইত, বলেছিল, বাবাই, পালাস না এভাবে। মা, এত প্রশ্ন ভিড় করে আসে, অথচ শাপমুক্ত হয়না।
"পুষে রাখে যেমন ঝিনুক, খোলসের আবরণে মুক্তোর সুখ,....দিও তোমার মালাখানি বাউলের এই মনটা রে।" ..... এই গান বেঁচে থাকা আর ভালো থাকার মধ্যে যে অজস্র মিথ্যে কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকে তাকে উপড়ে দেয়। গভীর মর্মমূল থেকে উঠে আসে "আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে", বাবা তাঁর মেয়েকে কোলে করে ঘুম পাড়াচ্ছে গতজন্মে, ঘুম ভেঙে যেতে যে দেখেছিল খুব ঝড়ে কাকের বাসাটা বাড়ির পাশের বাদাম গাছ থেকে পড়ে যাচ্ছে, অনেক ওপর থেকে কত নীচে,..... একটা সময় আর যখন কিছু দেখা যায় না তখন শব্দ শোনা যায়, ভেঙে পড়ার ।
তারপর নীল বন্দর খুঁজেছে কেউ। পাথরকুচি হৃদয়। কত কথা ভেঙে ভেঙে সেতু তৈরি হল। অথচ বাকি থেকে গেল কত সমুদ্র পারাপার। "The sea that year engraved in the window memory slain laid out in a shroud of light...."
Should I repent? For whom?
দুঃখ যাপন যদি দাও, হে মহাকাল, নীলকন্ঠ কর তবে তুমি।
Comments
Post a Comment